Thursday 13 June 2019

Guptipara Basanta Utsav

Guptipara Bosonto Utsab 2019

Guptipara Bosonto Utsab 2019


Guptipara basanta utsav is a one day program that held on guptipara Hooghly. This program is organised by the members of ebar guptipara community.They start this program from the year 2019.





Members of ebar guptipara community at bosonto utsav
This year they start the program at 8:00 a.m.at the starting they all reach to a ground called Jagoroni math,  the ground is the property of jagoroni Sangha.after preparing everything they start a road show  on all over guptipara.



Guptipara basanta utsav rally
 on the basanta Utsav program through the road show the cover the whole guptipara through out there rally.at the end they finish there rally at the same place from where they had started.After complete rally they distribute tiffin for everyone who participate in this rally with them.


Guptipara Bosonto Utsab 2019 Cultural evening program 


Guptipara Bosonto Utsab 2019 Cultural evening program dance perfomance


Monday 4 February 2019

গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবন চন্দ্রের মন্দির।।


বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটির উচ্চতা ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সাত (৭) দিন মাসীর বাড়ি থাকার পর উল্টোরথের প্রাক্কালে অর্থাৎ বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে ফেরার ঠিক পূর্ব দিন মাসীর বাড়িতে ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব খুব ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতর ও বারান্দার পশ্চাৎ-এর অংশ অনুকরণীয় অলংকরণের দ্বারা সমৃদ্ধ। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গায়ের নকশা জীর্ণ যদিও, ‘মঠ’ ভারতের ‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’এর নজরদারির আওতাধীন।

গুপ্তিপাড়ায় বারোয়ারি পূজার প্রচলন।।

গুপ্তিপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ‘সেন রাজা’দের বাড়ির দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও এঁদের মধ্যে ১২ জন একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দ (মতান্তরে ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ) থেকে বাংলা দেশের মধ্যে প্রথম ‘বারোয়ারি দুর্গাপূজা’র প্রচলন ঘটান – এই কথাও প্রচলিত। বারো (১২) জন বন্ধু বা ইয়ারের সংগঠন বলে ‘বারোয়ারি’ পুজো। সঠিক প্রমাণ না থাকলেও অন্যান্য প্রামাণিক তথ্যাবলী থেকে বলা যায় যে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে বলরাম বসু ঘাট রোডের ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে আয়োজিত পুজোই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো।

গুপ্তিপাড়ার রথযাত্রা।।


গুপ্তিপাড়ার রথ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘতম বা সর্বাপেক্ষা উচ্চতা বিশিষ্ট। ওড়িশার পুরীর মন্দিরের রথ সমগ্র ভারতবর্ষে অন্যান্য রথের তুলনায় সর্বাধিক দূরত্ব অতিক্রম করে। দ্বিতীয় দীর্ঘতম দূরত্ব (প্রায় ২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের গুপ্তিপাড়ার রথ। উনবিংশ শতকের প্রারম্ভে নির্মিত বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির থেকে গুপ্তিপাড়ার রথ প্রতি বছর রথযাত্রার দিন গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারে শ্রী গোপাল মন্দিরের উদ্দেশ্য, শুভ যাত্রার সূচনা করে। এই রথের চারটি রশি বা দড়ি’র একটি পিছনে থাকে ও রথ’এর ‘ব্রেক’ রূপে কাজ করে; একটি রশি কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি দুটি রশি’র সাহায্যে রথ সম্মুখভাগে পরিচালিত করা হয়। এখানে সোজা রথের দিন গঙ্গা তীরবর্তী মন্দির থেকে রথে চেপে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ‘গুণ্ডিচা-ঘর’এ আসেন। রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়ায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়; বসে বিরাট মেলা।

গুপ্তিপাড়ার দোল ও রথযাত্রা।

গুপ্তিপাড়ার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে  প্রধান ও বিখ্যাত উৎসব হল দোল ও রথযাত্রা। ৪০০ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাইল পথের দু’ ধারে মেলা বসে। উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয় এখানে। প্রথা অনুযায়ী ভোগ নিবেদন করার পর ভক্তরা ভোগ লুট করে নেন। বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যতম। পূর্বভারতের নানা অঞ্চল থেকে রথের রশি টানার জন্যে মানুষ আসেন। গুপ্তিপাড়ায় রথযাত্রার সুত্রপাত। কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) এর সময়াকালে প্রতিষ্ঠিত ও ভারতবর্ষে কয়েকশো বছরের প্রাচীন রথগুলোর মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ ভারতবর্ষে চতুর্থ প্রাচীন রথ রূপে পরিগণিত হয়। ওড়িশার পুরী, শ্রীরামপুরের মাহেশ ও মেদিনীপুরের মহিষাদলের পর গুপ্তিপাড়ার রথ আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত হয়।

গুপ্তিপাড়া শিক্ষা ও সংস্কৃতি।।

একসময় সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান চর্চা ও তন্ত্র সাধনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল গুপ্তিপাড়া। ইংরেজ শাসনের সময় সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চা এক অত্যুচ্চ মর্যাদা বিশিষ্ট আসন লাভ করে। সমগ্র বঙ্গভূমি, অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থান হয়ে ওঠে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চা ও আহরণের অন্যতম পীঠস্থান। এই সব অঞ্চলের মধ্যে ব্যাকরণ, স্মৃতি, ন্যায় প্রভৃতি বিষয়ে চর্চার প্রধানতম কেন্দ্র রূপে স্থান লাভ করে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ। নবদ্বীপ ব্যতীত চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়া বা ভট্টপল্লী, হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া ও ত্রিবেণী, বর্ধমান, হাওড়া জেলার বালি, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এবং পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, কোটালিপাড়া, সিলেট সহ বহু অঞ্চলে অসংখ্য টোল বা সংস্কৃত চতুষ্পাঠী স্থাপিত হয় এবং উন্নততর জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র রূপে খ্যাতি লাভ করে।

ইতিহাসের পাতায় গুপ্তিপাড়া।।

গুপ্তিপাড়া, বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ও ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ চলচ্চিত্র খ্যাত প্রসিদ্ধ কবিয়াল 'ভোলা ময়রা' র জন্মভূমি। ‘ভোলা ময়রা’র পিতৃদত্ত নাম ভোলানাথ নায়েক – পারিবারিক পেশার কারণেই নামকরণ হয় ভোলা ময়রা। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম প্রধান সেনাপতি  ‘মোহনলাল’ এই গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন; যদিও ‘মোহনলালের’ সঠিক জাতি, ধর্ম বিষয় জানা যায় না। রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ‘কালী মির্জা’ গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘কালী মির্জা’র পিতৃদত্ত নাম কালীদাস মুখোপাধ্যায়। সংস্কৃত ব্যতীত ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শিতা, ইসলাম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ও ইসলাম ধর্মাবিলম্বীগণের ন্যায় পরিধান ব্যবহারের জন্য তিনি ‘মির্জা’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে রাজা প্রতাপ চাঁদ’এর সঙ্গীত সভার আসনও অলংকৃত করেন। ‘কালী মির্জা’র প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর যিনি নিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু ‘টপ্পা’ গানের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটান; নিধুবাবুও এই অঞ্চলেরই মানুষ। গীতিকার, সুরকার ‘কালী মির্জা’ রচিত ও সুরারোপিত বিভিন্ন প্রকারের সঙ্গীত প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। কালী,রাধা,কৃষ্ণ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে প্রেম ও ভক্তি রসাত্মক বহু সঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে ‘কালী মির্জা’এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন।

গুপ্তিপাড়ার শিল্পকর্ম।।

ভারতবর্ষ, বিশেষত বঙ্গভূমি, ইংরেজ শাসনে দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় অসংখ্য পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু পরিবার তাঁত শিল্পকে তাঁদের প্রধানতম জীবিকা রূপে নির্বাচিত করে গুপ্তিপাড়ায় বসবাস শুরু করেন; এঁদের তৈরি মোটা তাঁতের শাড়ির অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্রয়ের জন্য চালান দেওয়া হয়। হুগলী-বর্ধমান অঞ্চল চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলেরই কেন্দ্রস্থলে অবস্থানরত গুপ্তিপাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণমানের ধান / চাল উৎপন্ন হয়। কথিত আছে, গুপ্তিপাড়াতেই বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পের সূচনা হয়। গরুর দুধের তৈরি ছানায় প্রস্তুত এখানকার ‘গুঁপো’ সন্দেশ বাংলাদেশের প্রথম ‘ব্রান্ডেড’ সন্দেশ রূপে পরিগণিত। এছাড়াও, গুপ্তিপাড়ার ‘হিমসাগর’ আম অতি সুস্বাদু ও রসাল।

গুপ্তিপাড়ার অর্থনীতি।।

কর্মসংস্থানের দিক থেকে বিচার করলে সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৮৪৫ জন বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মধ্যে ৮৭.২২ % জন বছরে ছয় মাস বিভিন্ন চাকুরীসূত্রে আয় করেন; ১১.৯৫ % জন বছরে ছয় মাসের কম সময় ধরে বিভিন্ন সূত্রে আয় করেন। ৮৪৫ জন কর্মজীবীর মধ্যে ৬০ জনের প্রধান জীবিকা নিজস্ব জমিতে বা যৌথ মালিকানায় চাষ এবং ২৩৪ জন ক্ষেত মজুর।

গুপ্তিপাড়ার আয়তন।।

আয়তনে গুপ্তিপাড়া প্রায় ৭৩ হেক্টর বা ১৮০.৪৮ একর। ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৬৮৪ জন; অধিকাংশ বাসিন্দাই হিন্দু – জাতিতে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে ৫৫৭ টি পরিবারে ২১৬৯ জন বসবাস করেন। সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বিচার করলে গুপ্তিপাড়ার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বেশ উচ্চ স্থানই অধিকার করে। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে গড় সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৬.২৬%, সেখানে গুপ্তিপাড়ায় ৮৩.৯২ %। এখানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৮৭.২২ % ও মহিলাদের ৮০.৫৭ % ।

গুপ্তিপাড়া এর ইতিহাস।।

#গুপ্তিপাড়া
GuptiPara, Hooghly
নদিয়া, বর্ধমান ও হুগলি – এই তিন জেলার সম্মিলিত কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত গুপ্তিপাড়া। গুপ্তিপাড়া, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলায় বলাগড় থানার প্রত্যন্ত ব্লক বলাগড়ের অন্তর্গত ও ভাগীরথী নদীর দক্ষিণ তীর থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত। ব্যান্ডেল-কাটোয়া লুপ লাইনে গুপ্তিপাড়া স্টেশন থেকে গুপ্তিপাড়া গ্রামে পৌঁছান যায়। সড়কপথেও যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে; এই গ্রামের উপর দিয়েই ‘অসম লিঙ্ক রোড’ বা STKK Road (সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কালনা-কাটোয়া সড়ক) চলে গিয়েছে। অর্থাৎ, ভৌগলিক অবস্থানগত দিক থেকে বিচার করলে একদিকে বর্ধমান ও গঙ্গার অপর পাড়ে নদিয়া, শান্তিপুর প্রভৃতি সমৃদ্ধ জনপদের সংযোগস্থলে ইতিহাস ও বঙ্গ সংস্কৃতির সংমিশ্রণের উল্লেখযোগ্য ধারক ও বাহক ছোট্ট এই অঞ্চল – #গুপ্তিপাড়া।
আয়তনে গুপ্তিপাড়া প্রায় ৭৩ হেক্টর বা ১৮০.৪৮ একর। ১৯৫১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে এই গ্রামের জনসংখ্যা ছিল ৬৮৪ জন; অধিকাংশ বাসিন্দাই হিন্দু – জাতিতে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে ৫৫৭ টি পরিবারে ২১৬৯ জন বসবাস করেন। সাক্ষরতার হারের দিক থেকে বিচার করলে গুপ্তিপাড়ার অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে বেশ উচ্চ স্থানই অধিকার করে। ২০১১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে গড় সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৬.২৬%, সেখানে গুপ্তিপাড়ায় ৮৩.৯২ %। এখানে পুরুষের সাক্ষরতার হার ৮৭.২২ % ও মহিলাদের ৮০.৫৭ % ।
কর্মসংস্থানের দিক থেকে বিচার করলে সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ৮৪৫ জন বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। এঁদের মধ্যে ৮৭.২২ % জন বছরে ছয় মাস বিভিন্ন চাকুরীসূত্রে আয় করেন; ১১.৯৫ % জন বছরে ছয় মাসের কম সময় ধরে বিভিন্ন সূত্রে আয় করেন। ৮৪৫ জন কর্মজীবীর মধ্যে ৬০ জনের প্রধান জীবিকা নিজস্ব জমিতে বা যৌথ মালিকানায় চাষ এবং ২৩৪ জন ক্ষেত মজুর।
ভারতবর্ষ, বিশেষত বঙ্গভূমি, ইংরেজ শাসনে দ্বিখণ্ডিত হওয়ায় অসংখ্য পূর্ববঙ্গীয় উদ্বাস্তু পরিবার তাঁত শিল্পকে তাঁদের প্রধানতম জীবিকা রূপে নির্বাচিত করে গুপ্তিপাড়ায় বসবাস শুরু করেন; এঁদের তৈরি মোটা তাঁতের শাড়ির অধিকাংশই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিক্রয়ের জন্য চালান দেওয়া হয়। হুগলী-বর্ধমান অঞ্চল চাল উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এই অঞ্চলেরই কেন্দ্রস্থলে অবস্থানরত গুপ্তিপাড়ায় পশ্চিমবঙ্গের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণমানের ধান / চাল উৎপন্ন হয়। কথিত আছে, গুপ্তিপাড়াতেই বাংলার মিষ্টান্ন শিল্পের সূচনা হয়। গরুর দুধের তৈরি ছানায় প্রস্তুত এখানকার ‘গুঁপো’ সন্দেশ বাংলাদেশের প্রথম ‘ব্রান্ডেড’ সন্দেশ রূপে পরিগণিত। এছাড়াও, গুপ্তিপাড়ার ‘হিমসাগর’ আম অতি সুস্বাদু ও রসাল।
গুপ্তিপাড়া, বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় ও ‘এন্টনি ফিরিঙ্গি’ চলচ্চিত্র খ্যাত প্রসিদ্ধ কবিয়াল 'ভোলা ময়রা' র জন্মভূমি। ‘ভোলা ময়রা’র পিতৃদত্ত নাম ভোলানাথ নায়েক – পারিবারিক পেশার কারণেই নামকরণ হয় ভোলা ময়রা। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার অন্যতম প্রধান সেনাপতি  ‘মোহনলাল’ এই গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন; যদিও ‘মোহনলালের’ সঠিক জাতি, ধর্ম বিষয় জানা যায় না। রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গীত শিক্ষাগুরু ‘কালী মির্জা’ গুপ্তিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ‘কালী মির্জা’র পিতৃদত্ত নাম কালীদাস মুখোপাধ্যায়। সংস্কৃত ব্যতীত ফার্সি ও উর্দু ভাষায় পারদর্শিতা, ইসলাম শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা ও ইসলাম ধর্মাবিলম্বীগণের ন্যায় পরিধান ব্যবহারের জন্য তিনি ‘মির্জা’ নামে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করেন। কিছুদিনের জন্য বর্ধমানে রাজা প্রতাপ চাঁদ’এর সঙ্গীত সভার আসনও অলংকৃত করেন। ‘কালী মির্জা’র প্রধানতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন পাথুরিয়াঘাটার গোপীমোহন ঠাকুর যিনি নিধি গুপ্ত বা নিধুবাবু ‘টপ্পা’ গানের সঙ্গে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মেলবন্ধন ঘটান; নিধুবাবুও এই অঞ্চলেরই মানুষ। গীতিকার, সুরকার ‘কালী মির্জা’ রচিত ও সুরারোপিত বিভিন্ন প্রকারের সঙ্গীত প্রভূত জনপ্রিয়তা লাভ করে। কালী,রাধা,কৃষ্ণ প্রভৃতিকে কেন্দ্র করে প্রেম ও ভক্তি রসাত্মক বহু সঙ্গীত সৃষ্টির মাধ্যমে ‘কালী মির্জা’এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন।
একসময় সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত বিভিন্ন বিষয়ে গভীর জ্ঞান চর্চা ও তন্ত্র সাধনার অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল গুপ্তিপাড়া। ইংরেজ শাসনের সময় সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চা এক অত্যুচ্চ মর্যাদা বিশিষ্ট আসন লাভ করে। সমগ্র বঙ্গভূমি, অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থান হয়ে ওঠে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার মাধ্যমে জ্ঞান চর্চা ও আহরণের অন্যতম পীঠস্থান। এই সব অঞ্চলের মধ্যে ব্যাকরণ, স্মৃতি, ন্যায় প্রভৃতি বিষয়ে চর্চার প্রধানতম কেন্দ্র রূপে স্থান লাভ করে নদীয়া জেলার নবদ্বীপ। নবদ্বীপ ব্যতীত চব্বিশ পরগণার ভাটপাড়া বা ভট্টপল্লী, হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া ও ত্রিবেণী, বর্ধমান, হাওড়া জেলার বালি, বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এবং পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর, চট্টগ্রাম, কোটালিপাড়া, সিলেট সহ বহু অঞ্চলে অসংখ্য টোল বা সংস্কৃত চতুষ্পাঠী স্থাপিত হয় এবং উন্নততর জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র রূপে খ্যাতি লাভ করে।
বর্তমানেও, যে কয়েকটি প্রাচীন ব্রাহ্মণ পরিবার পুরুষানুক্রমে গুপ্তিপাড়ায় বসবাস করেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই সংস্কৃত ভাষায় কৃতবিদ্য; এখনও বেশ কিছু টোল বা সংস্কৃত চতুষ্পাঠী, সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও চর্চার জন্য বিখ্যাত। ভূর্জ পত্র বা তালপাতায় লেখা বহু প্রাচীন পুঁথি এই অঞ্চলের “শিশির বাণী মন্দির” নামক সরকারী পাঠাগারে ও কিছু পুঁথি ব্যক্তিগত সংগ্রহে, সযত্নে রক্ষিত। বহু নৈয়ায়িক, শাস্ত্রজ্ঞ, সংস্কৃত ভাষায় কৃতবিদ্য পণ্ডিতকূলের প্রাচীন বাস ও কর্মভূমি রূপে গুপ্তিপাড়া ভারতবর্ষের প্রাচীন জ্ঞান আহরণ ও আস্বাদনের অন্যতম প্রকৃষ্ট স্থান।
সমগ্র গুপ্তিপাড়া গ্রাম জুড়েই প্রাচীন বহু দেবদেবীর থান, মন্দির প্রভৃতি বর্তমান। প্রাচীন এইসব দেবদেবীর নিবিড় সন্মিলিত সহাবস্থান ও পরিবেশগত রূপে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করার জন্য এই অঞ্চলকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ও বলা হয়। গুপ্তিপাড়ার নামকরণ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত প্রচলিত থাকলেও ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’ থেকে ‘গুপ্ত বৃন্দাবন পল্লী’, ‘গুপ্তপল্লী’ ও পরিশেষে ‘গুপ্তিপাড়া’ নামকরণ হয়েছে – এই যুক্তি অধিক গ্রহণযোগ্য।
মধ্যযুগ থেকেই গুপ্তিপাড়ার প্রসিদ্ধি। প্রাচীন গুপ্তিপাড়ার উল্লেখ ১৪৯৫ খ্রীষ্টাব্দে বিপ্রদাস পিপিলাই রচিত ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যে পাওয়া যায় – চাঁদ সওদাগরের ভাগীরথীর প্রবাহে চম্পকনগরী থেকে তরী ভাসিয়ে নদীপথে কাটোয়া, গুপ্তিপাড়া, ত্রিবেণী, সপ্তগ্রাম, ভাটপাড়া, মূলাজোর, গারুলিয়া, ইছাপুর, কাঁকিনাড়া, চানক (ব্যারাকপুর), খড়দহ, আড়িয়াদহ, চিত্রপুর বা চিৎপুর, কলিকাতা, কালীঘাট প্রভৃতি অঞ্চল অতিক্রম করে সাগর সঙ্গমে উপনীত হওয়ার বিবরণ বর্তমান।
গুপ্তিপাড়ায় রাস, দোল, রথযাত্রা, জগদ্ধাত্রী পূজা প্রভৃতি ধর্মীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন অনুসঙ্গসহ মহা আড়ম্বর সহকারে অনুষ্ঠিত হয়। কথিত আছে, গুপ্তিপাড়াতে (১৭৫৯ – ১৭৬০ খ্রীষ্টাব্দে) গৃহকর্তার আর্থিক অনটনের জন্যে একটি জগদ্ধাত্রী পূজা প্রায় বন্ধের উপক্রম হওয়ায় অঞ্চলের বারো জন যুবক নিজেরা ব্যক্তিগত রূপে চাঁদা সংগ্রহ করে কোনক্রমে পুজোটিকে রক্ষা করে এবং এই ভাবেই ‘শ্রী শ্রী বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী’র পুজো গুপ্তিপাড়াতে প্রচলনের মাধ্যমে বাংলা দেশের প্রথম ‘বারোয়ারি পূজা’র সুত্রপাত ঘটে। বর্তমানে, সমগ্র গুপ্তিপাড়ায় অসংখ্য জগদ্ধাত্রী’দেবীর পূজা আয়োজিত হয়। “রথ সাধক ময়দান”এ জগদ্ধাত্রী দেবীর পূজার আয়োজকগণ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রসহ শোভাযাত্রা ও আলোকবাজির প্রদর্শন দর্শনীয়রূপে উপস্থিত করেন। উল্লেখ্য, অবিভক্ত বাংলায় পারিবারিক জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
গুপ্তিপাড়ার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্যে  প্রধান ও বিখ্যাত উৎসব হল দোল ও রথযাত্রা। ৪০০ বছরের প্রাচীন বৃন্দাবনচন্দ্রের রথযাত্রা শুরু হয় রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে। বৃন্দাবন মঠের সামনে থেকে বাজার পর্যন্ত দীর্ঘ এক মাইল পথের দু’ ধারে মেলা বসে। উল্টোরথের আগের দিন ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব ধুমধামের সাথে পালিত হয় এখানে। প্রথা অনুযায়ী ভোগ নিবেদন করার পর ভক্তরা ভোগ লুট করে নেন। বাংলার ঐতিহ্যশালী ও বড় রথগুলির মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ অন্যতম। পূর্বভারতের নানা অঞ্চল থেকে রথের রশি টানার জন্যে মানুষ আসেন। গুপ্তিপাড়ায় রথযাত্রার সুত্রপাত। কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের বংশধর ও নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় (১৭১০-১৭৮৩) এর সময়াকালে প্রতিষ্ঠিত ও ভারতবর্ষে কয়েকশো বছরের প্রাচীন রথগুলোর মধ্যে গুপ্তিপাড়ার রথ ভারতবর্ষে চতুর্থ প্রাচীন রথ রূপে পরিগণিত হয়। ওড়িশার পুরী, শ্রীরামপুরের মাহেশ ও মেদিনীপুরের মহিষাদলের পর গুপ্তিপাড়ার রথ আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত হয়।
গুপ্তিপাড়ার রথ পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে দীর্ঘতম বা সর্বাপেক্ষা উচ্চতা বিশিষ্ট। ওড়িশার পুরীর মন্দিরের রথ সমগ্র ভারতবর্ষে অন্যান্য রথের তুলনায় সর্বাধিক দূরত্ব অতিক্রম করে। দ্বিতীয় দীর্ঘতম দূরত্ব (প্রায় ২ কিলোমিটার) অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের গুপ্তিপাড়ার রথ। উনবিংশ শতকের প্রারম্ভে নির্মিত বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির থেকে গুপ্তিপাড়ার রথ প্রতি বছর রথযাত্রার দিন গুপ্তিপাড়ার বড়বাজারে শ্রী গোপাল মন্দিরের উদ্দেশ্য, শুভ যাত্রার সূচনা করে। এই রথের চারটি রশি বা দড়ি’র একটি পিছনে থাকে ও রথ’এর ‘ব্রেক’ রূপে কাজ করে; একটি রশি কেবলমাত্র মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত। বাকি দুটি রশি’র সাহায্যে রথ সম্মুখভাগে পরিচালিত করা হয়। এখানে সোজা রথের দিন গঙ্গা তীরবর্তী মন্দির থেকে রথে চেপে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা ‘গুণ্ডিচা-ঘর’এ আসেন। রথযাত্রা উপলক্ষে গুপ্তিপাড়ায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়; বসে বিরাট মেলা।
গুপ্তিপাড়ার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ‘সেন রাজা’দের বাড়ির দুর্গাপূজায় অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন ও এঁদের মধ্যে ১২ জন একত্রিত হয়ে একটি সংগঠন তৈরি করে ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দ (মতান্তরে ১৭৯০ খ্রীষ্টাব্দ) থেকে বাংলা দেশের মধ্যে প্রথম ‘বারোয়ারি দুর্গাপূজা’র প্রচলন ঘটান – এই কথাও প্রচলিত। বারো (১২) জন বন্ধু বা ইয়ারের সংগঠন বলে ‘বারোয়ারি’ পুজো। সঠিক প্রমাণ না থাকলেও অন্যান্য প্রামাণিক তথ্যাবলী থেকে বলা যায় যে ১৯১০ খ্রীষ্টাব্দে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে বলরাম বসু ঘাট রোডের ‘সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’র উদ্যোগে আয়োজিত পুজোই কলকাতার প্রথম বারোয়ারি দুর্গাপুজো।
‘বারোয়ারি’ এবং ‘সর্বজনীন’ পুজো এখন প্রায় সমার্থক রূপে ব্যবহৃত হলেও এই দুটি’র মধ্যে কিছুটা পার্থক্য বিদ্যমান। বাড়ির বা পারিবারিক পূজা সাধারণত পরিবার বা ছোট্ট গণ্ডীর মধ্যেই আবদ্ধ; ‘বারোয়ারি’ পূজার পরিব্যাপ্তি কিঞ্চিৎ অধিক। অন্যদিকে, ‘সর্বজনীন’ পূজা বা ‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’এর অর্থ হল – আর্থ-সামাজিক সকল অবস্থানের উর্দ্ধে হিন্দু, অহিন্দু, ধনী, নির্ধন সকলেই এই পূজাকে কেন্দ্র করে এই উৎসবের আনন্দ সমভাবে উপভোগ করার সমান অংশীদার।
উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ বসু’র প্রতিষ্ঠিত ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’ ছিল বিপ্লবীদের আস্তানা। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে ‘সিমলা ব্যায়াম সমিতি’র উদ্যোগে বিপ্লবী অতীন্দ্রনাথ কলকাতায় সর্বপ্রথম সর্বজনীন দুর্গোৎসবের সূচনা করেন (মতান্তরে, কলকাতার তেলিপাড়ায় ১৯১৩ খ্রীষ্টাব্দে ও ১৯১৩ সিকদার বাগান’এ ‘সর্বজনীন দুর্গোৎসব’এর সূচনা হয়, যা আজ দিকে দিকে প্রচলিত)। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু,শরৎচন্দ্র বসু, ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত বিপ্লবীগণ এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
গুপ্তিপাড়ায় বৈষ্ণব সংস্কৃতির প্রভাবে রাস, দোল, রথযাত্রা, জগদ্ধাত্রী বা দুর্গাপূজা প্রভৃতি নিয়ে আগ্রহের আতিশয্য লক্ষ্য করা অস্বাভাবিক নয়। যদিও, এই অঞ্চল প্রধানত চৈতন্যদেব, কৃষ্ণচন্দ্র, বৃন্দাবনচন্দ্র এবং রামচন্দ্রের নামে উৎস্বর্গীকৃত ৪ টি ইটের তৈরি মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। এই চারটি মন্দির একই প্রাঙ্গণের মধ্যে অবস্থিত ও এই মন্দিরগুলির সমষ্টিকে বলা হয় ‘গুপ্তিপাড়ার মঠ’। বাংলার নিজস্ব মন্দির স্থাপত্যের ছাঁদে অর্থাৎ চালাঘরের আদর্শে নির্মাণ, এই মন্দিরগুলির বিশেষত্ব।
#গুপ্তিপাড়ার_মঠ এর এই চারটি মন্দিরের মধ্যে চৈতন্যদেবের মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা প্রাচীন; ‘জোড় বাংলা’ রীতিতে আনুমানিক সপ্তদশ দশকের মধ্য ভাগে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়। ‘জোড় বাংলা’ রীতি অর্থাৎ অপূর্ব কারুকার্য খচিত চৈতন্যদেবের এই মন্দিরের স্থাপত্য বা নির্মাণ শৈলী উত্তম রূপে নিরীক্ষণ করলে স্পষ্ট মনে হয় যেন দুটি দোচালা কুটির পরস্পর সংলগ্ন অবস্থায় বিদ্যমান। চৈতন্যদেবের এই মন্দিরে বাংলার অপূর্ব ‘টেরাকোটা’ স্থাপত্যের প্রথম দিকের নিদর্শন ছিল বলেই অনুমান করা হয়। ‘টেরাকোটা’র এইসকল অপূর্ব নিদর্শনগুলি কালের গহ্বরে সবই প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে শুধু ইতিহাস বইয়ের পাতায় আর বংশানুক্রমে গুপ্তিপাড়ায় বসবাসকারী মানুষজনের মুখে মুখে। বর্তমানে,এই মন্দিরের অধিকাংশ কারুকার্যই পলেস্তরায় ঢাকা।
নবাব আলিবর্দি খাঁ-র শাসনকালে (রাজত্বকাল ১৭৪০ – ১৭৫৬ খ্রীষ্টাব্দ) ও নবমদন্ডী পীতাম্বরানন্দের মঠাধিকার কালে (আনুমানিক ১৭৪৫ খ্রীষ্টাব্দে) শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়; যদিও কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দিরটি ১০ বছর পর অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে (আনুমানিক ১৭৫৫ খ্রীষ্টাব্দে) স্থাপিত হয়।
মোঘল সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে যোগসিদ্ধ মহাপুরুষ, দশনামী শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত পরিব্রাজক ও সন্ন্যাসী সত্যদেব সরস্বতী বা প্রথম দন্ডিস্বামী ছিলেন জগৎগুরু শঙ্করাচার্য্যের অন্যতম ভক্তশিষ্য। সত্যদেব সরস্বতী স্বপ্নাদৃষ্ট হয়ে নদীয়া জেলার শান্তিপুরের এক বিধবার কুটীর থেকে শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের অর্থাৎ ‘বিষ্ণু’দেবের বিগ্রহ সংগ্রহ করেন। সত্যদেব সরস্বতী’র প্রধান ভক্তশিষ্য জমিদার বিশ্বেশ্বর রায় শ্রীবৃন্দাবনচন্দ্রের উদ্দ্যেশ্যে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি দান করলে, সত্যদেব গুপ্তিপাড়াকে তাঁর সাধনা স্থল রূপে নির্বাচন করেন ও বিশ্বেশ্বর রায়ের দান করা জমিতে ‘মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন ও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটি (আনুমানিক ১৫৮৫ খ্রীষ্টাব্দে) নির্মিত হয়। বর্তমান বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটি বাগবাজারের জমিদার গঙ্গানারায়ণ সরকার কর্তৃক উনবিংশ শতকের প্রারম্ভে (আনুমানিক ১৮১১ খ্রীষ্টাব্দে) শাস্ত্র মতানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়।
উঁচু বেদীর উপর কৃষ্ণচন্দ্র ও বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির দুটি প্রতিষ্ঠিত ও বাংলার ‘আটচালা’ রীতিতে নির্মিত। কৃষ্ণচন্দ্র, বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের অনন্য বৈশিষ্ট্য–এই মন্দির দুটির উপরের তলে অন্য একটি ‘চারচালা’ মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের গর্ভগৃহের সামনে ৩ টি প্রবেশ পথ যুক্ত একটি বারান্দা। ৩ টি প্রবেশ পথেই ‘খিলান’ বা ‘আর্চ’ বর্তমান। খিলানগুলি কারুকার্য খচিত ‘স্তম্ভ’ ও ‘উপস্তম্ভ’এর উপর ন্যস্ত।
বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরটির উচ্চতা ১৮ মিটার বা ৬০ ফুট। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সাত (৭) দিন মাসীর বাড়ি থাকার পর উল্টোরথের প্রাক্কালে অর্থাৎ বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরে ফেরার ঠিক পূর্ব দিন মাসীর বাড়িতে ‘ভাণ্ডারলুট’ উৎসব খুব ধুমধাম সহকারে পালিত হয়। বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গর্ভগৃহের ভিতর ও বারান্দার পশ্চাৎ-এর অংশ অনুকরণীয় অলংকরণের দ্বারা সমৃদ্ধ। উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দিরের গায়ের নকশা জীর্ণ যদিও, ‘মঠ’ ভারতের ‘পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ’এর নজরদারির আওতাধীন।
এই চারটি মন্দিরের মধ্যে রামচন্দ্রের মন্দির শিল্প-সুষমা সমৃদ্ধ কারুকার্য্যের জন্য সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। প্রচলিত আছে যে, শেওড়াফুলির রাজা হরিশচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে রামচন্দ্রের মন্দিরটি নির্মাণ করেন। এই মন্দিরের গড়ন ও অঙ্গসৌষ্ঠব ১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে বাঁশবেড়িয়ায় প্রতিষ্ঠিত বাসুদেবের মন্দিরের সমগোত্রীয়। রামচন্দ্রের মন্দির ‘চারচালা’ রীতিতে নির্মিত হলেও এই মন্দিরের ছাদের মধ্যে ভাগে আটকোণা মন্দিরের একটি ক্ষুদ্রাকৃতি অনুকৃতি বর্তমান। মন্দিরের দক্ষিণ ও পশ্চিম দেওয়াল পোড়ামাটির অপূর্ব ফলকে শোভিত – রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনী, কৃষ্ণলীলা, বানিজ্যের জন্য সমুদ্র যাত্রা প্রভৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী পোড়ামাটির অসাধারণ ভাস্কর্য্যে রুপায়িত হয়েছে। পোড়ামাটির তৈরি এই সব অপূর্ব ‘টেরাকোটা’ বা মৃৎফলকগুলি তৎকালীন বাংলায় শিল্পকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শনের সাক্ষ্য বহন করে।
প্রধানত বৈষ্ণব সংস্কৃতি দ্বারা গুপ্তিপাড়া প্রভাবিত হলেও গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্য শুধু বৈষ্ণব সংস্কৃতি ও মন্দিরেই সীমাবদ্ধ নয়। তন্ত্র সাধনার অন্যতম সাধনপীঠ রূপে পাঁচশো বছরের প্রাচীন ‘দেশকালী মন্দির’ বা ‘দেশকালিকা মাতা’র পঞ্চমুণ্ডির আসন, মশান কালী বা ডাকাত কালী পূজা, পরিব্রাজক কৃষ্ণানন্দ স্বামী, রঘুনাথ দেব, বেহুলা নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিতা প্রায় দুশ বছরের প্রাচীন সর্বমঙ্গলা কালীমাতা, ঊনবিংশ শতাব্দীতে হাটখোলা পাড়ায় কীর্ত্তি চন্দ্র সেন পরিবারের রামধন সেন কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘জোড়বাংলা’ শিবমন্দির, মনোরম পরিবেশের জন্য গুপ্তিপাড়ার পাশের চরকৃষ্ণবাটি প্রভৃতির জন্য এই অঞ্চল সোনার বাংলার কথাই মনে করায়।
গুপ্তিপাড়ায় পর্যটক রূপে সামান্য সময় অতিবাহিত করলেই তৎকালীন সমৃদ্ধ বাংলার উচ্চ মানের কৃষ্টি, সংস্কৃতির গভীরতা, শেকড়ের টান স্বচ্ছন্দে সময়কে যেন বহু যুগ পেছনে নিয়ে যায়; নিস্তরঙ্গ জীবনে প্রাণের জোয়ারে বয়ে আনে হারিয়ে যাওয়া সেই সময়ের প্রতি শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা, বহু যুগের অপার হতে।

TEST